২০২২ সালের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের সংগ্রামী অভিবাদন গ্রহন করুন। আমরা জানি বরাক উপত্যকার তিন জেলার মোট ভূ-ভাগের প্রায় ৫৮ শতাংশ বন-জঙ্গলে ঘেরা। তবুও বরাকে পরিবেশ দূষণের প্রভাব মারাত্মকভাবে পড়ছে। এবছর মে মাসে আচমকা বন্যার পর এরকমটিই জানিয়েছেন বিষেষজ্ঞরা। প্রবলহারে বন-জঙ্গল ধ্বংস এবং পাহাড় কেটে ফেলা এর অন্যতম কারণ।
এই উপত্যকা একসময় প্রাইমেটদের স্বর্গরাজ্য বলে জানা যেতো। এখানকার সবুজ বনাঞ্চলগুলো স্লো-লরিস, রিসাস মেকক, আসামি মেকক, পায়ারী বানর, কেপড লঙ্গুর, বনরুই, গুইসাপ, কচ্ছপ এবং নানারকম অজগর সাপের বিচরণ ভূমি। পূর্বে এখানে সুমাত্রীয় গণ্ডারও পাওয়া যেতো। কিন্তু উন্নয়নের নামে সবুজ ভস্মীকরনের ফলে এই সমস্ত বহুকাল বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গবেষকদের মতে, এখানে বর্তমানে ২১ প্রজাতির পাখি বিলুপ্তির পথে। তাদের মধ্যে দুইটি খুব শীঘ্রই বিলুপ্ত হবে, তিনটি বিলুপ্তপ্রায় এবং আরোও ১০টি প্রজাতি খুব তাড়াতাড়ি বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতিতে পরিণত হতে চলেছে । এ অবস্থায় বরাকের বনসমূহের সংরক্ষণ দরকার। অথচ এই উপত্যকার অর্থনৈতিক নীতিতে এই সব পরিবেশ সংক্রান্ত উদ্বেগের কোন প্রতিফলন নেই। ডলু-লালভাগে সরকারী উদ্যোগে প্রায় ত্রিশলক্ষ গাছ কেটে এয়ারপোর্ট বানানোর প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এর সাথে ভরাট করে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে ১টি জলাশয় এবং কয়েকটি পুকুর ছাড়াও আরো নানারকম জলের উৎস ও জলাভূমি । সেই সাথে লোপ পাবে নানারকমের পশুপাখি, কীটপতঙ্গ তথা উদ্ভিদ এবং প্রাণিকুল।
পরিবেশ রক্ষা ভারত সরকারের একটি সাংবিধানিক কর্তব্য। ভারতীয় সংবিধানের ৪৮(ক) অণুচ্ছেদমতে সরকারের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে পরবেশ রক্ষা, পশুপাখি সংরক্ষন তথা বন সংরক্ষণের প্রতি সরকারের তরফ থেকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। তাছাড়া, ভারতীয় উচ্চতম ন্যায়ালয় এম সি মেহতা ভার্সাস ভারতীয় গ্ণরাজ্য সহ আরোও নানা মামলায় এই মত প্রকাশ করেছেন যে স্বচ্ছ বায়ু, স্বচ্ছ জলসহ পরিচ্ছন্ন পরিবেশ জনগণের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। সংবিধানের ৫১ -ক ধারা মতে পরিবেশ, জলবায়ু এবং বন্য জীবজন্তু সংরক্ষণ করা ভারতীয় নাগরিকদের জরুরি কর্তব্যও বটে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আন্দোলনের ক্ষেত্রে রিও ঘোষণাপত্রকে (The United Nations Conference on Environment and Development,1992) পরিবেশ সংক্রান্ত অধিকারের বিষয়ে যুগান্তকারী বলে ধরা হয়। সেই ঘোষণাপত্র মতে অর্থনৈতিক উন্নতির কেন্দ্রবিন্দুতে মানুষের স্বাস্থ্য এবং কার্যক্ষম জীবন হওয়া উচিত। তাই প্রত্যেকটি বৃহৎ অর্থনৈতিক প্রকল্পের ক্ষেত্রে প্রথমে পরিবেশের উপর এর বিরূপাত্মক প্রভাব পর্যালোচনা করে দেখতে হবে। সেইসাথে, আদিবাসীদের অধিকার সংক্রান্ত রাষ্ট্রসংঘের আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্রেও (UN Declaration on the Rights of Indigenous Peoples, 2007), যার স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর মধ্যে ভারত অন্যতম, পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আদিবাসীদের অধিকারকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। কারণ পরিবেশ সংরক্ষণে সকল দেশেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন সেখানকার আদিবাসী জনগোষ্টীরা। তাদের সংস্কৃতি এবং জীবনচর্যা পরিবেশ-বান্ধব। তাই পরিবেশ সংরক্ষণ করতে হলে প্রথমে জল-জংগল-জমির উপর তাদের প্রাপ্য অধিকার সংরক্ষণ করা দরকার। যে সকল জমি, এলাকা এবং সম্পদ তারা পুরুষানুক্রমে ব্যবহার করে আসছেন সেই সকল ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর তাঁদের অধিকার সুরক্ষা করতে হবে। এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষার ক্ষেত্রে আদিবাসীদের পরম্পরাগত জ্ঞানকে গুরুত্ব দিতে হবে।
এমনকি ভারত সরকারও ২০০৬ সালের বনাধিকার আইন (Scheduled Tribes And Other Traditional Forest Dwellers (Recognition Of Forest Rights) Act, টো০৬) এর মাধ্যমে এই অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। নিয়ম করা হয়েছে যে, আদিবাসী এলাকাতে গণ-শুণানির মাধ্যমে সম্মতি সংগ্রহ না- করা পর্যন্ত ঐ জমি অন্য কোনও কাজে ব্যবহার করা যাবে না৷ অথচ ডলুতে দু-দুটি গ্রামসভা ভেস্তে যাওয়ার পরেও কোনও অজ্ঞাত কারণে জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। এছাড়াও ১৯৮৬ সালের পরিবেশ (সুরক্ষা) আইন (Environment (Protection) Act, 1986) অধীনে পরিবেশ-প্রভাব মূল্যায়ন বিজ্ঞপ্তি ২০০৬ (Environment Impact Assessment Notification, 2006) নাম জারিকৃত এক বিজ্ঞপ্তিতে বৃহৎ অর্থনৈতিক প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে রিও ঘোষোনাপত্রে গৃহীত নিয়ম অর্থাৎ পরিবেশের এর উপর এর প্রভাব এর মূল্যায়ন (environmental impact assessment ) কেও বাধ্যতামূলক করে। তথ্য জানার অধিকার আইনের দ্বারা প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্য মতে ডলু-লালবাগের ক্ষেত্রে এই নিয়মটিও মান্য করা হয়নি। এরপর আদিবাসী জনগণ নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্য রাস্তায় আন্দোলনে নামলে তাদের উপর দমনমূলক নির্যাতন চালানো হচ্ছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারার অধীনে নানা নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশ জারি করে রাখা হয়েছে।
আমরা স্থিতিশীল উন্নয়ণ চাই। স্থিতিশীল উন্নয়নের ধারণাটিকে ১৯৮৭ সালের ব্রান্টল্যান্ড কমিশন বলা হয়েছে যে ইটা এমন এক “উন্নয়ন যা ভবিষ্যত প্রজন্মের নিজস্ব চাহিদা মেটাতে সক্ষমতার সাথে আপস না করে বর্তমানের চাহিদা পূরণ করে।” পরিবেশ ধ্বংস করে স্থিতিশীল উন্নয়ন হয় না। যে উন্নয়ন ভবিষ্যত প্রজন্মের বিপদ ডেকে আনে সেই উন্নয়ন বর্তমান ও ভবিষ্যৎ উভয় প্রজন্মের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতার নামান্তর।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার এবং কর্তব্যের কথা স্মরণ রেখে আমরা নিম্নলিখিত ব্যক্তি তথা সংগঠন এই যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে নিম্নলিখিত দাবিগুলো উত্থাপন করছি:
১। ডলু বাগান সংক্রান্ত মৌ-চুক্তি(Memorandum of Understanding) অতি সত্তর বাতিল করা হোক।
২। বাগানে জারি থাকা ১৪৪ ধারা অতিসত্বর প্রত্যাহার করা হোক।
৩। অধিকৃত জমিতে সরকারী নিয়ম মতে পাট্টা প্রদান করে বসবাসকারী লোকদের মালিকানা সুনিশ্চিত করা হোক।
৪। যেহেতু মৌ-চুক্তি (Memorandum of Understanding) থেকে এটা স্পষ্ট যে বহুদিন ধরে বাগানে শ্রমিকদের প্রাপ্য টাকা বকেয়া রয়েছে, তাদের সেই টাকা মিটিয়ে দেওয়া হোক।
৫। যে চারাগাছ তথা ছায়াতরু কেটে ফেলা হয়েছে সেগুলোর জায়গায় পুনঃরায় বনায়ণ করা হোক।
বরাক হিউম্যান রাইটস প্রটেকশন কমিটি (BHRPC)
বরাক ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (BDF)
হামদের বাত